পূর্ববর্তী নবী ‘আলাইহিমুস সালামগণের ঘটনাবলিতে রয়েছে শিক্ষা ও উপদেশ। তারা আমাদের আলোকবর্তিকা ও আলোর মিছিল। আল্লাহ বলেন,
﴿ لَقَدۡ كَانَ فِي قَصَصِهِمۡ
عِبۡرَةٞ لِّأُوْلِي ٱلۡأَلۡبَٰبِۗ مَا كَانَ حَدِيثٗا يُفۡتَرَىٰ وَلَٰكِن
تَصۡدِيقَ ٱلَّذِي بَيۡنَ يَدَيۡهِ وَتَفۡصِيلَ كُلِّ شَيۡءٖ وَهُدٗى
وَرَحۡمَةٗ لِّقَوۡمٖ يُؤۡمِنُونَ ١١١ ﴾ [يوسف: ١١١]
‘তাদের এ কাহিনীগুলোতে অবশ্যই বুদ্ধিমানদের জন্য রয়েছে শিক্ষা, এটা
কোনো বানানো গল্প নয়, বরং তাদের পূর্ববর্তী কিতাবের সত্যায়নকারী এবং
প্রতিটি বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ। আর হিদায়াত ও রহমত ঐ কওমের জন্য যারা ঈমান
আনে।’ {সূরা ইউসূফ, আয়াত : ১১১}
মক্কায় যখন ঈমানদারের সংখ্যা মুষ্টিমেয়, পথ যখন দুর্গম অথচ দীর্ঘ-
মুসলিমরা যখন এর শেষের দেখা পাচ্ছিল না, তখন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর এসব বৃত্তান্ত নাযিল হত। এসব বৃত্তান্ত তাদের
পথের শেষ উন্মোচিত করত। গন্তব্যের শেষ রেখা উদ্ভাসিত করত। তাদের সঙ্গে পথ
চলত এবং তাদের হাত ধরত। এসব ছিল রাসূল ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের
হৃদয় স্থির করার অভিপ্রায়ে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَكُلّٗا نَّقُصُّ عَلَيۡكَ مِنۡ
أَنۢبَآءِ ٱلرُّسُلِ مَا نُثَبِّتُ بِهِۦ فُؤَادَكَۚ وَجَآءَكَ فِي
هَٰذِهِ ٱلۡحَقُّ وَمَوۡعِظَةٞ وَذِكۡرَىٰ لِلۡمُؤۡمِنِينَ ١٢٠ ﴾ [هود:
١٢٠]
‘আর রাসূলদের এসব সংবাদ আমরা তোমার কাছে বর্ণনা করছি যার দ্বারা আমরা
তোমার মনকে স্থির করি আর এতে তোমার কাছে এসেছে সত্য এবং মুমিনদের জন্য
উপদেশ ও স্মরণ। {সূরা হূদ, আয়াত : ১২০}
আল্লাহ যেন তাঁর নবীকে বুঝাতে চান, আপনি দুর্গম পথে একা নন। আল্লাহর ভাষ্য যেমন বলছে,
﴿ فَٱصۡبِرۡ كَمَا صَبَرَ أُوْلُواْ ٱلۡعَزۡمِ مِنَ ٱلرُّسُلِ ٣٥ ﴾ [الاحقاف: ٣٥]
‘অতএব তুমি ধৈর্যধারণ কর, যেমন ধৈর্যধারণ করেছিল সুদৃঢ় সংকল্পের অধিকারী রাসূলগণ।’ {সূরা আল-আহকাফ, আয়াত : ৩৫}
আজ আমরা নবীদের মধ্যে একজনের ঘটনা শুনব, যে ঘটনা আমাদের নবীকে বলছিল-
সাবধান তুমি যেন দাওয়াতের দায়িত্ব ও রেসালতের গুরুভার ফেলে যেও না। যেন
বলছিল,
﴿ فَٱصۡبِرۡ لِحُكۡمِ رَبِّكَ وَلَا تَكُن كَصَاحِبِ ٱلۡحُوتِ إِذۡ نَادَىٰ وَهُوَ مَكۡظُومٞ ٤٨ ﴾ [القلم: ٤٨]
‘অতএব তুমি তোমার রবের হুকুমের জন্য ধৈর্যধারণ কর। আর তুমি মাছওয়ালার
মত হয়ো না, যখন সে দুঃখে কাতর হয়ে ডেকেছিল।’ {সূরা আল-কলম, আয়াত : ৪৮}
এ হলো ইউনুস ‘আলাইহিস সালামের ঘটনা। আল্লাহ তাকে মসুলের নাইনাওয়াবাসীর
কাছে প্রেরণ করেছিলেন। তিনি তাদেরকে আল্লাহর তাওহীদ ও ইবাদতের প্রতি
আহ্বান জানান। তারা তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে এবং নিজেদের কুফরী ও
অবাধ্যতায় অটল থাকে। তাদের এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে ইউনুস ‘আলাইহিস সালাম
রাগে-ক্ষোভে তাদের ছেড়ে চলে আসেন। তিনি তাদেরকে তিনদিন পর আযাব নাযিলের
সতর্কবার্তা ঘোষণা করেন।
রাগত অবস্থায় ইউনুস ‘আলাইহিস সালাম তাদের ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন এ কথা
ভেবে যে পৃথিবীর ব্যাপ্তি অনেক, গ্রামের সংখ্যা বহু ও জাতির ধরন বিভিন্ন।
ফলে আল্লাহ একে সংকীর্ণ করবেন না। আর এরা যেহেতু দাওয়াতের অবাধ্যতায়
অপরিবর্তিত, সেহেতু আল্লাহ হয়তো অন্য জাতিকে তাঁর প্রতি ঝুঁকে দেবেন। আর
এটাই আল্লাহর বাণীর মর্ম :
﴿ وَذَا ٱلنُّونِ إِذ ذَّهَبَ مُغَٰضِبٗا فَظَنَّ أَن لَّن نَّقۡدِرَ عَلَيۡهِ ﴾ [الانبياء: ٨٧]
‘আর স্মরণ কর যুন-নূনের কথা, যখন সে রাগান্বিত অবস্থায় চলে গিয়েছিল
এবং মনে করেছিল যে, আমি তার ওপর সংকীর্ণ করব না।’ {সূরা আম্বিয়া, আয়াত :
৮৭}
অর্থাৎ তার জন্য দুনিয়াকে সংকীর্ণ করব না। এদিকে ইউনুস ‘আলাইহিস
সালামের উম্মত যখন দেখল নবী চলে গেছেন এবং তাদের ওপর আযাব অবতরণ অবধারিত,
তখন আল্লাহ তাদের অন্তরে তাওবা ও অনুশোচনা ঢেলে দিলেন। নবীর সঙ্গে কৃত
আচরণের জন্য তারা অনুতপ্ত হলো। আল্লাহর প্রতি বিনত হলো এবং তাঁর সামনে
বিগলিত হলো। এ ছিল এক বড় মুহূর্ত। ফলে নিজ শক্তি ও সামর্থ্য এবং দয়া ও
করুণায় আল্লাহ তাদের পরিত্রাণ দিলেন। তাদের আযাব উঠিয়ে নিলেন যার কারণ ও
অনুঘটক কেবল তাদের সঙ্গেই মিলে গিয়েছিল, তারা ছাড়া অন্য কারও ছিলো না।
যখনই কোনো উম্মত তাদের নবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে অতঃপর তাদের ওপর
আযাব নাযিল হয়েছে, তখন তারা ঈমান এনেছে আর সে ঈমান তাদের কাজে এসেছে এমনটি
দৃশ্যমান হয় না, তবে ইউনুসের কাওম এর ব্যতিক্রম। আল্লাহ তা‘আলা সূরা ইউনুসে
বলেন,
﴿ فَلَوۡلَا كَانَتۡ قَرۡيَةٌ
ءَامَنَتۡ فَنَفَعَهَآ إِيمَٰنُهَآ إِلَّا قَوۡمَ يُونُسَ لَمَّآ
ءَامَنُواْ كَشَفۡنَا عَنۡهُمۡ عَذَابَ ٱلۡخِزۡيِ فِي ٱلۡحَيَوٰةِ
ٱلدُّنۡيَا وَمَتَّعۡنَٰهُمۡ إِلَىٰ حِينٖ ٩٨ ﴾ [يونس: ٩٨]
‘সুতরাং কেন হল না এমন এক জনপদ, যে ঈমান এনেছে এবং তার ঈমান তার
উপকারে এসেছে? তবে ইউনুসের কওম ছাড়া যখন তারা ঈমান আনল, তখন আমরা তাদের
থেকে দুনিয়ার জীবনের লাঞ্ছনাকর আযাব সরিয়ে দিলাম এবং আমরা তাদেরকে একটি সময়
পর্যন্ত ভোগ করতে দিলাম।’ {সূরা ইউনুস, আয়াত : ৯৮}
অসন্তুষ্টি ইউনুস ‘আলাইহিস সালামকে সমুদ্রতীরে নিয়ে উপনীত করল। সেখানে
তিনি যাত্রী ও মাল বোঝাই এক জাহাজে চড়লেন। মাঝ দরিয়ায় ঢেউ ও বাতাস
জাহাজটিকে ঝুঁকিয়ে ফেলল। সহযাত্রীরা এ থেকে ইঙ্গিত খুঁজে পেল যে যাত্রীদের
মধ্যে কেউ একজন রয়েছে যার ওপর আল্লাহ অসন্তুষ্ট। তিনি কোনো অনুচিত কাজ করে
এসেছেন। সেহেতু জাহাজটিকে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচাতে তাকে পানি ফেলে দেওয়ার
কোনো বিকল্প নেই। অথবা ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচাতে জাহাজের বোঝা হাল্কা করতে
চাইল। এ লক্ষ্যে তারা যাত্রীদের নামে লটারি দিল। দেখা গেল ইউনুস ‘আলাইহিস
সালামের নামই বেরিয়ে এলো। তাদের অন্তর তাঁকে ফেলে দিলে সায় দিচ্ছিল না।
কিন্তু বারবার লটারি দিলেও একের পর এক শুধু তার নামই বেরিয়ে আসতে থাকল।
আল্লাহ বলেন,
﴿ وَإِنَّ يُونُسَ لَمِنَ ٱلۡمُرۡسَلِينَ ١٣٩ إِذۡ أَبَقَ إِلَى ٱلۡفُلۡكِ ٱلۡمَشۡحُونِ ١٤٠ ﴾ [الصافات: ١٣٩، ١٤٠]
‘আর নিশ্চয় ইউনুসও ছিল রাসূলদের একজন। যখন সে একটি বোঝাই নৌযানের দিকে পালিয়ে গিয়েছিল।’ {সূরা আস-সাফফাত, আয়াত : ১২৯-১৪০}
আল্লাহ তাঁর বেরিয়ে যাওয়াকে পালানো বলেছেন যেভাবে গোলাম তার মুনিবকে
ছেড়ে পালিয়ে যায়। কারণ তিনি আল্লাহর অনুমতি ছাড়াই জনপদ থেকে বেরিয়েছিলেন।
পরের আয়াতে আল্লাহ বলেন,
﴿ فَسَاهَمَ فَكَانَ مِنَ ٱلۡمُدۡحَضِينَ ١٤١ ﴾ [الصافات: ١٤١]
‘অতঃপর সে লটারিতে অংশগ্রহণ করল এবং তাতে সে হেরে গেল।’ {সূরা আস-সাফফাত, আয়াত : ১৪১}
এরপর তাকে সাগরে নিক্ষেপ করা হলো। আল্লাহ বলেন,
﴿ فَٱلۡتَقَمَهُ ٱلۡحُوتُ وَهُوَ مُلِيمٞ ١٤٢ ﴾ [الصافات: ١٤٢]
‘তারপর বড় মাছ তাকে গিলে ফেলল। আর সে (নিজেকে) ধিক্কার দিচ্ছিল।’ {সূরা সাফফাত, আয়াত : ১৪২}
তিনি ধিক্কারযোগ্য হয়ে যান। কারণ তিনি সে মহান দায়িত্ব ছেড়ে চলে
যাচ্ছিলেন আল্লাহ যা দিয়ে তাঁকে প্রেরণ করেছিলেন। আল্লাহ তাঁকে অনুমতি না
দিতেই তিনি স্বজাতিকে ত্যাগ করে যাচ্ছিলেন অসন্তুষ্টিবশত। মাছ তাঁকে আহার
বানাল অথচ তাঁর এতটুকু গোশত খেল না কিংবা তার কোনো হাড্ডিতে ঠোকর দিল না।
মেছের পেটে তিনি থাকলেন যতক্ষণ আল্লাহ তাঁকে রাখতে চাইলেন। মাছের অন্ধকার,
সাগরের অন্ধকার ও রাতের অন্ধকার- অন্ধকারের পর অন্ধকারে তিনি নিজের রবকে
কাতরভাবে ডাকলেন,
﴿ لَّآ إِلَٰهَ إِلَّآ أَنتَ سُبۡحَٰنَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ ٱلظَّٰلِمِينَ ٨٧ ﴾ [الانبياء: ٨٧]
‘আপনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। আপনি পবিত্র মহান। নিশ্চয় আমি ছিলাম যালিম।’ {সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ৮৭}
বর্ণিত হয়েছে যে ফেরেশতারা তাঁর এ কাতর প্রার্থনা শুনে বললেন, হে রব, এ
দেখি অচেনা দেশ থেকে আসা চেনা মানুষের ক্ষীণ কণ্ঠ! আল্লাহ তাঁর ডাকে সাড়া
দিলেন এবং তাঁকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত করলেন। আল্লাহর ভাষায়,
﴿ فَٱسۡتَجَبۡنَا لَهُۥ وَنَجَّيۡنَٰهُ مِنَ ٱلۡغَمِّۚ وَكَذَٰلِكَ نُۨجِي ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ٨٨ ﴾ [الانبياء: ٨٨]
‘অতঃপর আমরা তার ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম এবং দুশ্চিন্তা থেকে তাকে উদ্ধার
করেছিলাম। আর এভাবেই আমরা মুমিনদেরকে উদ্ধার করে থাকি।’ {সূরা আল-আম্বিয়া,
আয়াত: ৮৮}
এমন ঘনঘোর বিপদে ইউনুস ‘আলাইহিস সালাম মাছের পেটে আল্লাহর তাছবীহ পড়তে
লাগলেন এবং দো‘আ করতে থাকলেন। মাছ তাঁকে সমুদ্রতীরে উগড়ে দিল। এমন স্থানে
যেখানে কোনো উদ্ভিদ বা ছায়া ছিল না। তিনি তখন শারীরিকভাবে একেবারে দুর্বল।
আল্লাহ বলেন,
﴿ ۞فَنَبَذۡنَٰهُ بِٱلۡعَرَآءِ وَهُوَ سَقِيمٞ ١٤٥ وَأَنۢبَتۡنَا عَلَيۡهِ شَجَرَةٗ مِّن يَقۡطِينٖ ١٤٦ ﴾ [الصافات: ١٤٥، ١٤٦]
‘অতঃপর আমরা তাকে তৃণলতাহীন প্রান্তরে নিক্ষেপ করলাম এবং সে ছিল
অসুস্থ। আর আমরা একটি ইয়াকতীন (লাউজাতীয়) গাছ তার ওপর উদগত করলাম।’ {সূরা
আস-সাফফাত, আয়াত : ১৪৫-১৪৬}
এটি এমন গাছ যা তাকে বড় পাতা দিয়ে ছায়া দেয় এবং তার গায়ে মাছি বসতে
বাধা দেয়। নবী ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত যে তিনি লাউ
পছন্দ করতেন এবং বাসনের পাশ থেকে খুঁজে নিয়ে খেতেন।
অতঃপর আল্লাহ তাঁকে উম্মতের কাছে ফিরে যেতে নির্দেশ দেন। তারা তাঁকে
সত্য বলে গ্রহণ করে এবং তাঁর প্রতি ঈমান আনে। তাদের সংখ্যা ছিল অন্যূন এক
লাখ। এ হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর নবীকে সম্মানিত করা ও শ্রেষ্ঠত্ব দানের
নমুনা। আর আমাদের নবী মুহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন
উম্মতের সংখ্যার দিক দিয়ে সব নবীর সেরা। যেমন আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু
‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَا مِنَ الأَنْبِيَاءِ نَبِيٌّ إِلَّا
أُعْطِيَ مَا مِثْلهُ آمَنَ عَلَيْهِ البَشَرُ، وَإِنَّمَا كَانَ الَّذِي
أُوتِيتُ وَحْيًا أَوْحَاهُ اللَّهُ إِلَيَّ، فَأَرْجُو أَنْ أَكُونَ
أَكْثَرَهُمْ تَابِعًا يَوْمَ القِيَامَةِ»
‘প্রত্যেক নবীকেই এমন কিছু (অলৌকিক নিদর্শন) প্রদান করা হয়েছে যার
অনুযায়ী তাঁর ওপর মানুষ ঈমান এনেছে। আর আমাকে যে নিদর্শন দেওয়া হয়েছে তা
হলো অহী, যা আল্লাহ আমার ওপর প্রত্যাদেশ হিসেবে প্রেরণ করেছেন। (যা কিয়ামত
পর্যন্ত অবিকল টিকে থাকবে)। সেহেতু আমি আশা করি আমি কিয়ামতের দিন তাঁদের
মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনুসারীর অধিকারী হব।’ [বুখারী : ৪৯৮১]
এ হলেন ইউনুস ‘আলাইহিস সালাম। আল্লাহর একজন সম্মানিত নবী। আবদুল্লাহ
ইবন ‘আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَا يَنْبَغِي لِأَحَدٍ أَنْ يَقُولَ أَنَا خَيْرٌ مِنْ يُونُسَ بْنِ مَتَّى»
‘কারও জন্য এমন বলা সমীচীন নয় যে আমি ইউনুস ইবন মাত্তা থেকে উত্তম।’ [বুখারী : ৪৬০৩; মুসলিম : ২৩৭৬]
এমন সম্মানিত নবী সূরা নিসা ও আন‘আমে উল্লেখিত সম্মানিত নবীদের কাতারে
যাকে রাখা হয়েছে আর যাদের সম্পর্কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে অনুসরণের। আল্লাহর
ভাষায়,
﴿ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ هَدَى ٱللَّهُۖ فَبِهُدَىٰهُمُ ٱقۡتَدِهۡۗ ٩٠ ﴾ [الانعام: ٩٠]
‘এরাই তারা, যাদেরকে আল্লাহ হিদায়াত করেছেন। অতএব তাদের হিদায়াত তুমি অনুসরণ কর।’ {সূরা আল-আন‘আম, আয়াত : ৯০}
আর ইউনুস ‘আলাইহিম সালামের এ ঘটনায় মহান অনুসরণ হলো ওই হিদায়াত বা পথনির্দেশ যার কথা আল্লাহ বলেছেন নিম্নোক্ত আয়াতে। আল্লাহ বলেছেন,
﴿ فَٱصۡبِرۡ لِحُكۡمِ رَبِّكَ وَلَا تَكُن كَصَاحِبِ ٱلۡحُوتِ إِذۡ نَادَىٰ وَهُوَ مَكۡظُومٞ ٤٨ ﴾ [القلم: ٤٨]
‘অতএব তুমি তোমার রবের হুকুমের জন্য ধৈর্যধারণ কর। আর তুমি মাছওয়ালার
মত হয়ো না, যখন সে দুঃখে কাতর হয়ে ডেকেছিল।’ {সূরা কলম, আয়াত : ৪৮}
অতএব দাওয়াতপ্রচারকদের কাজ হবে যে কোনো মূল্যে নিজের দায়িত্ব পালন করে
যাওয়া এবং এ পথে পাওয়া কষ্ট ও মিথ্যা অভিযোগে ধৈর্য ধরা। অটল অবিচল থাকা
এবং বারবার সুপথে আহ্বান অব্যাহত রাখা।। মানুষ যতই বিমুখতা দেখাক তাদের
সংশোধন থেকে নিরাশ না হওয়া।
তাই রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসারীদেরও অবশ্য
কর্তব্য হবে, ধৈর্যধারণ করা এবং সহ্য করা। অবিচল থাকা এবং অধ্যবসায় চালিয়ে
যাওয়া। সর্বোপরি বারবার দাওয়াতের পুনরাবৃত্তি করতে থাকা। তেমনি তার জন্য
বৈধ নয় মানুষের অন্তর সংশোধিত হওয়া বা হৃদয় সাড়া দেওয়ার ব্যাপারে হতাশ
হওয়া। যতই তারা অস্বীকার বা মিথ্যা প্রতিপন্ন করুক কিংবা অবাধ্যতা ও
বিমুখতা দেখাক না কেন।
ডাকে সাড়া না দেওয়ায় মানুষের ওপর রাগ করা তো সংশোধন প্রত্যাশীদের জন্য
সহজ বৈ কি। কিন্তু এটা তো সত্যকে সাহায্য করবে না। মুমিন তাই নিজের ক্রোধ
হজম করে এবং চলমান থাকে। তার জন্য সবরই শ্রেয়। আর শেষ পরিণাম মুত্তাকীদের
জন্য। আল্লাহর ভাষায়,
﴿ وَلَقَدۡ نَعۡلَمُ أَنَّكَ يَضِيقُ
صَدۡرُكَ بِمَا يَقُولُونَ ٩٧ فَسَبِّحۡ بِحَمۡدِ رَبِّكَ وَكُن مِّنَ
ٱلسَّٰجِدِينَ ٩٨ وَٱعۡبُدۡ رَبَّكَ حَتَّىٰ يَأۡتِيَكَ ٱلۡيَقِينُ ٩٩ ﴾
[الحجر: ٩٧، ٩٩]
‘আর অবশ্যই আমরা জানি যে, তারা যা বলে তাতে তোমার অন্তর সঙ্কুচিত হয়।
সুতরাং তুমি তোমার রবের প্রশংসায় তাসবীহ পাঠ কর এবং সিজদাকারীদের
অন্তর্ভুক্ত হও। আর ইয়াকীন (মৃত্যু) আসা পর্যন্ত তুমি তোমার রবের ইবাদাত
কর।’ {সূরা আল-হিজর, আয়াত : ৯৭-৯৯}
হে বিপন্ন ব্যথিত চিন্তিত ব্যক্তি, নবীদের দোয়ায় তোমার জন্য রয়েছে আদর্শ। ইমাম
আহমদ ও তিরমিযী রহিমাহুমাল্লাহ সহীহ সূত্রে বর্ণনা করেছেন, সা‘দ ইবন আবী
ওয়াক্কাছ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«دَعْوَةُ ذِي النُّونِ إِذْ دَعَا وَهُوَ
فِي بَطْنِ الحُوتِ: لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ
مِنَ الظَّالِمِينَ، فَإِنَّهُ لَمْ يَدْعُ بِهَا رَجُلٌ مُسْلِمٌ فِي
شَيْءٍ قَطُّ إِلاَّ اسْتَجَابَ اللَّهُ لَهُ.»
‘মাছের পেটে করা জুন্নুনের (মাছওয়ালা অর্থাৎ ইউনুস ‘আলাইহিস সালামের) দো‘আ,
‘আপনি ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই, আপনি সপ্রশংস মহান, নিশ্চয় আমি জুলুমকারীদের অন্তর্ভুক্ত।’
(উচ্চারণ: লা ইলাহা ইল্লা আনতা ছুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনায যোলিমীন)
এটি যে কোনো মুসলিম কোনো সময় পড়বে, আল্লাহ অবশ্যই তার দো‘আ কবুল করবেন।’ [তিরমিযী : ৩৫০৫; মুসনাদ আহমাদ : ১৪৬২]
‘আপনি ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই, আপনি সপ্রশংস মহান, নিশ্চয় আমি জুলুমকারীদের অন্তর্ভুক্ত।’
(উচ্চারণ: লা ইলাহা ইল্লা আনতা ছুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনায যোলিমীন)
এটি যে কোনো মুসলিম কোনো সময় পড়বে, আল্লাহ অবশ্যই তার দো‘আ কবুল করবেন।’ [তিরমিযী : ৩৫০৫; মুসনাদ আহমাদ : ১৪৬২]
আমাদেরকে অবশ্যই অমূল্য এ দো‘আটি ভেবে দেখা দরকার। এতে রয়েছে আল্লাহর
একত্ববাদের ঘোষণা, অংশীদারিত্বের অস্বীকৃতি ও নিজের যাবতীয় ভুলের
স্বীকারোক্তি। (অতএব নিজের দো‘আ কবুলের জন্য এ তিন বৈশিষ্ট্য রক্ষা করে করা
দরকার।)
ইমাম আহমদ রহ. আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
مَا قَالَ عَبْدٌ قَطُّ إِذَا أَصَابَهُ
هَمٌّ وَحَزَنٌ: اللَّهُمَّ إِنِّي عَبْدُكَ، وَابْنُ عَبْدِكَ، ابْنُ
أَمَتِكَ، نَاصِيَتِي بِيَدِكَ، مَاضٍ فِيَّ حُكْمُكَ، عَدْلٌ فِيَّ
قَضَاؤُكَ، أَسْأَلُكَ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ، سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ،
أَوْ أَنْزَلْتَهُ فِي كِتَابِكَ، أَوْ عَلَّمْتَهُ أَحَدًا مِنْ خَلْقِكَ،
أَوِ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِي عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدَكَ، أَنْ تَجْعَلَ
الْقُرْآنَ رَبِيعَ قَلْبِي، وَنُورَ صَدْرِي، وَجِلَاءَ حُزْنِي،
وَذَهَابَ هَمِّي، إِلَّا أَذْهَبَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ هَمَّهُ،
وَأَبْدَلَهُ مَكَانَ حُزْنِهِ فَرَحًا
‘যে ব্যক্তি কোনো বিপদ বা দুশ্চিন্তায় পড়ে বলবে (দু‘আর উচ্চারণ),
আল্লাহুম্মা ইন্নী ‘আব্দুকা অবনু ‘আব্দিকা অবনু ‘আমাতিকা, না-সিয়াতী বিয়য়াদিকা, মা-দ্বিন ফিইয়্যা হুকমুকা, আদলুন ফিইয়্যা ক্বাদ্বা-উকা, আসআলুকা বিকুল্লিস্মিন হুয়া লাকা, সাম্মাইতা বিহী নাফসাকা আউ আনযালতাহূ ফী কিতা-বিকা, আউ আল্লামতাহূ আহাদাম মিন খালক্বিকা, আও ইস্তা’’সারতা বিহী ফী ‘ইলমিল গাইবি ‘ইন্দাক; আন তাজ‘আলাল ক্বুরআ-না রাবী‘আ ক্বালবী অনূরা সাদরী অজালা-আ হুযনী অযাহা-বা হাম্মী।
(অর্থ: হে আল্লাহ, নিঃসন্দেহে আমি তোমার দাস, তোমার দাসের পুত্র ও তোমার দাসীর পুত্র, আমার ললাটের কেশগুচ্ছ তোমার হাতে। তোমার বিচার আমার জীবনে বহাল। তোমার মীমাংসা আমার ভাগ্যলিপিতে ন্যায়সঙ্গত। আমি তোমার নিকট তোমার প্রত্যেক সেই নামের অসীলায় প্রার্থনা করছি- যে নাম তুমি নিজে নিয়েছ। অথবা তুমি তোমার গ্রন্থে অবতীর্ণ করেছ, অথবা তোমার সৃষ্টির মধ্যে কাউকে তা শিখিয়েছ, অথবা তুমি তোমার গায়বী ইলমে নিজের নিকট গোপন রেখেছ, তুমি কুরআনকে আমার হৃদয়ের বসন্ত কর, আমার বক্ষের জ্যোতি কর, আমার দুশ্চিন্তা দূর করার এবং আমার উদ্বেগ চলে যাওয়ার কারণ বানিয়ে দাও।)
আল্লাহ তার দুশ্চিন্তা দূর করবেন এবং তার বিষাদকে হর্ষে বা আনন্দে পরিণত করে দেবেন।’ [মুসনাদ আহমাদ : ৪৩১৮]
আল্লাহুম্মা ইন্নী ‘আব্দুকা অবনু ‘আব্দিকা অবনু ‘আমাতিকা, না-সিয়াতী বিয়য়াদিকা, মা-দ্বিন ফিইয়্যা হুকমুকা, আদলুন ফিইয়্যা ক্বাদ্বা-উকা, আসআলুকা বিকুল্লিস্মিন হুয়া লাকা, সাম্মাইতা বিহী নাফসাকা আউ আনযালতাহূ ফী কিতা-বিকা, আউ আল্লামতাহূ আহাদাম মিন খালক্বিকা, আও ইস্তা’’সারতা বিহী ফী ‘ইলমিল গাইবি ‘ইন্দাক; আন তাজ‘আলাল ক্বুরআ-না রাবী‘আ ক্বালবী অনূরা সাদরী অজালা-আ হুযনী অযাহা-বা হাম্মী।
(অর্থ: হে আল্লাহ, নিঃসন্দেহে আমি তোমার দাস, তোমার দাসের পুত্র ও তোমার দাসীর পুত্র, আমার ললাটের কেশগুচ্ছ তোমার হাতে। তোমার বিচার আমার জীবনে বহাল। তোমার মীমাংসা আমার ভাগ্যলিপিতে ন্যায়সঙ্গত। আমি তোমার নিকট তোমার প্রত্যেক সেই নামের অসীলায় প্রার্থনা করছি- যে নাম তুমি নিজে নিয়েছ। অথবা তুমি তোমার গ্রন্থে অবতীর্ণ করেছ, অথবা তোমার সৃষ্টির মধ্যে কাউকে তা শিখিয়েছ, অথবা তুমি তোমার গায়বী ইলমে নিজের নিকট গোপন রেখেছ, তুমি কুরআনকে আমার হৃদয়ের বসন্ত কর, আমার বক্ষের জ্যোতি কর, আমার দুশ্চিন্তা দূর করার এবং আমার উদ্বেগ চলে যাওয়ার কারণ বানিয়ে দাও।)
আল্লাহ তার দুশ্চিন্তা দূর করবেন এবং তার বিষাদকে হর্ষে বা আনন্দে পরিণত করে দেবেন।’ [মুসনাদ আহমাদ : ৪৩১৮]
একইভাবে আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বুখারী ও
মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বিপদের সময় বলতেন :
«لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ العَلِيمُ
الحَلِيمُ، لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ رَبُّ العَرْشِ العَظِيمِ، لاَ
إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ رَبُّ السَّمَوَاتِ وَرَبُّ الأَرْضِ رَبُّ العَرْشِ
الكَرِيمِ»
উচ্চারণ: লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হুল আলীমুল হালীম, লা ইলা-হা
ইল্লাল্লা-হু রাব্বুল ‘আরশিল আযীম, লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু রাব্বুস
সামা-ওয়া-তি ওয়ারাব্বুল আরদি ওয়ারাব্বুল আরশিল কারীম।
অর্থ: আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য মাবুদ নেই; যিনি সর্বজ্ঞ,
সহিষ্ণু। আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই; যিনি মহান ‘আরশের প্রতিপালক।
আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য আরাধ্য নেই; যিনি আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও সম্মানিত
‘আরশের অধিপতি। [বুখারী : ৭৪২৬]
এ হলো দুশ্চিন্তা-টেনশনের নববী চিকিৎসা। যে ব্যক্তি বিশ্বাসের সঙ্গে
এসব পড়বে, আল্লাহ তার অন্তর উন্মোচন করে দেবেন ফলে তার কষ্টের কারণ দূর হয়ে
যাবে।