হিংসা-বিদ্বেষ মুনাফিকের চরিত্র। কোনো মুমিন অন্য মুমিনের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ রাখতে পারে না। এটি মুনাফিকদের একটি বদ স্বভাব।
কেবল মানুষের মধ্যেই নয়, পশুপাখির মধ্যেও এ বদ অভ্যাসটি দেখা যায়। আজ আমরা এ সম্পর্কে একটি গল্প শোনাব।
কচ্ছপ খুবই নিরীহ একটা প্রাণী। কচ্ছপ স্থলে যেমন বাস করে তেমনি পানিতেও
বাস করে। কচ্ছপের এত পরিচিতির একটা প্রধান কারণ হলো এই প্রাণীটি ধীর গতিতে
চলে। ধীর গতির উদাহরণ এলেই কচ্ছপের নামটিই সবার আগে উচ্চারিত হয়। বিশাল এই
পৃথিবীর কোনো এক কোণে বাস করত এরকমই একটি কচ্ছপ। তার বয়সও কম হয় নি। জীবনে
অনেক ঠাণ্ডা গরম, তিক্ত আর মিষ্টি অনেক রকমের অভিজ্ঞতা তার জীবনের ইতিহাসে
যুক্ত হয়েছে। বিচিত্র চড়াই-উৎরাইয়ের প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার কারণে
তাকে বানানো হয়েছে প্রাণীদের উপদেষ্টা। যে প্রাণীরই কোনো সমস্যা দেখা দিত
সে-ই চলে আসত কচ্ছপের কাছে পরামর্শ নেয়ার জন্য। কচ্ছপের কাছে বসত, লম্বা
সময় নিয়ে খোশগল্প করত, ফাঁকে নিজেদের সমস্যার কথা বলত। কচ্ছপও আন্তরিকতার
সাথে সবার সমস্যার কথা শুনত এবং তার দৃষ্টিতে যেটা উপযুক্ত সমাধান বলে মনে
করত-তা বলে দিত।
সবাই ওই কচ্ছপকে খুবই জ্ঞানী বলে মনে করত। তবে কাঁকড়াই শুধুমাত্র
কচ্ছপের ওপর সন্তুষ্ট ছিল না। কাঁকড়া কচ্ছপের অভিজ্ঞতা আর দীর্ঘ জীবনের
কোনো মূল্যায়নই করত না। সে বলত: ‘আমিও কচ্ছপের মতো। তার মতোই হাত পা
নাড়াই। তার মতোই পানিতে বসবাস করি এবং স্থলেও বাস করি। তাছাড়া আমার
তীক্ষ্ণধার দাঁত আছে কিন্তু কচ্ছপের নেই। আমি কচ্ছপের চেয়ে দ্রুত গতিতে
চলতে পারি। তাহলে প্রাণীরা কেন তাকে এত বেশি সম্মান করে, কেন সবাই তার কাছে
যায় নিজেদের সমস্যা সমাধানের জন্য? কেন তারা আমার কাছে সমস্যার সমাধানের
জন্য আসা তো দূরে থাক, আমাকে সালাম পর্যন্ত দেয় না?’
কাঁকড়ার মনে খুবই হিংসা হতো এবং সে চাইত তার ধারাল দাঁত নখ দিয়ে কচ্ছপের
ওপর হামলা চালিয়ে তাকে মেরে ফেলতে। কেবল চাইত বললে ভুল হবে, সে কয়েকবার
হামলাও করেছিল। কিন্তু কচ্ছপের ছিল ভীষণ শক্ত খোলস। কাঁকড়ার দাঁত নখ
কচ্ছপের ওই শক্ত খোলস ভেদ করা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। এ কারণে কাঁকড়া আরও
বেশি বিরক্ত ছিল। যখনই তাদের দুজনের দেখা হতো কাঁকড়া তখনই কচ্ছপকে এক গাল
বাজে কথা শুনিয়ে দিত যাতে কচ্ছপ বিরক্ত হয়। কিন্তু কচ্ছপ কখনোই কাঁকড়ার
কথায় প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে সোজা চলে যেত তার পথে।
একদিন হলো কী! একটা খরগোশ দৌড়ে দৌড়ে এসে হাজির হলো কচ্ছপের কাছে।
হাঁপাতে হাঁপাতে খরগোশ বলল যে, বনে আগুন লেগেছে। এক কান দু’কান হতে হতে
সবার কাছেই আগুন লাগার খবর পৌঁছে গেল। সবাই এসে হাজির হলো কচ্ছপের কাছে। এই
বিপদে এখন কী করণীয় তাদের সেটা জানার জন্যই একত্রিত হওয়া। কচ্ছপ খানিক চুপ
থেকে ভাবল। তারপর সমবেত প্রাণীদের উদ্দেশে বলল: ‘আমাদের সবার এখান থেকে
চলে যাওয়া উচিত। বাতাসের বেগে আগুন এখানে চলে আসার আশঙ্কা আছে।’
সাথে সাথেই প্রাণীরা সেখান থেকে পালাতে শুরু করে দিল। কেউ দ্রুত দৌড়াল,
কেউ উড়ে গেল ইত্যাদি যে যার মতো সরে যেতে লাগল। কচ্ছপ নিজেও তার মতো করে
ধীরে ধীরে পথ ধরল। একমাত্র প্রাণী যে কিনা কচ্ছপের কথায় কান দেয় নি, সে হলো
কাঁকড়া। সে প্রাণীদের যাবার পথে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল: ‘তোমরা কী
বোকা, মূর্খ, কচ্ছপের কথায় তোমরা তোমাদের বাসাবাড়ি ছেড়ে অজানার পথে পাড়ি
দিচ্ছ। বাতাস কোথায় যে এখানে আগুন নিয়ে আসবে?’
কিন্তু কাঁকড়ার কথায় কেউ কান দিল না। কাঁকড়ার পাশ দিয়ে যে প্রাণীটা সবার
শেষে গেল সে হলো কচ্ছপ। কাঁকড়া তাকে দেখে উপহাসের হাসি দিয়ে বলল: তুমি
কোথায় যাচ্ছো হে বুড়ো কচ্ছপ?
কচ্ছপ বলল: আমি চীন ও মচীন যাচ্ছি…
কাঁকড়া বুঝতে পারে নি যে কচ্ছপ তাকে বোকা বানাচ্ছে। সে জানতো চীন অনেক
দূরে। কচ্ছপ যেরকম ধীরে ধীরে চলে তাতে আরও দশ বছরেও চীন যেতে পারবে না সে।
সেজন্য বলল:
এই গতিতে হেঁটে তুমি
চাচ্ছ যেতে চীনা ভূমি?
এই বলে আবারও সে হাসতে হাসতে বলল: “আহা রে! বেচারা প্রাণীগুলো দেখ কী
রকম একটা বেআক্কেল প্রাণীর হাতে পড়ে নিজেদের বিবেককেও জলাঞ্জলি দিয়েছে!”
প্রাণীগুলো বহুদূর গিয়ে আরেকটা জায়গায় সমবেত হয়ে জীবন যাপন করতে লাগল।
ভালোভাবেই
কাটছিল তাদের। কিন্তু কাঁকড়ার যে কী পরিণতি হলো সেই খবরটাও তাদের
কাছে আর কোনোদিনই গেল না। তার মানে তো বুঝতেই পারছ তোমরা। কচ্ছপের কথাই
সত্যি হয়েছিল এবং আগুনে পুড়ে কাবাব হয়ে গিয়েছিল কাঁকড়া। আর অপরাপর প্রাণীরা
সুখে শান্তিতেই তাদের জীবন কাটাতে লাগল।
এ পর্যায়ে কচ্ছপ সম্পর্কে কিছু জানা-অজানা তথ্য জানাব:
কচ্ছপ এক ধরনের সরীসৃপ যারা পানি ও ডাঙা দুই জায়গাতেই বাস করে। এদের
শরীরের উপরের অংশ শক্ত খোলসে ঢাকা থাকে যা শরীরকে যেকোনো বিপদ-আপদ থেকে
রক্ষা করে।
বর্তমানে কচ্ছপের প্রায় ৩০০ প্রজাতি পৃথিবীতে রয়েছে, এদের মধ্যে কিছু
প্রজাতি এখন বিলুপ্তির পথে রয়েছে। কচ্ছপ বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তার নিজের
শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা পরিবর্তন করতে পারে, সাধারণত এ ধরনের
প্রাণীদের ঠাণ্ডা-রক্তের প্রাণী বলে অভিহিত করা হয়। অন্যান্য প্রাণীর মত
এরা নিশ্বাস গ্রহণ করে।
কচ্ছপরা সাধারণত মানুষেরই মত বাঁচে কিন্তু কিছু কচ্ছপ ১৫০ বছর পর্যন্ত বাঁচে বলে জানা যায়।
কচ্ছপের অনেক প্রজাতি পানিতে বা পানির আশেপাশে বাস করলেও এরা ডাঙায় ডিম
ছাড়ে। মেয়ে কচ্ছপরা ডিমের জন্য গর্ত করে এবং সেখানে ১ থেকে ৩০টি
পর্যন্ত ডিম পাড়ে। তারা সাধারণত রাতের বেলা ডিম পাড়ে এবং ডিম পাড়ার পর
মা কচ্ছপ ডিমগুলোকে মাটি, বালি বা অন্য যেকোন জৈব পদার্থ দিয়ে ঢেকে দেয়।
মা কচ্ছপ ডিম পাড়ার পর ডিমগুলো প্রকৃতির দায়িত্বে রেখে চলে যায়। ডিম
ফুটে বাচ্চা বের হতে প্রজাতি বিশেষে ৬০ থেকে ১২০ দিন সময় লাগে। ডিমের আকার
মায়ের আকারের উপর নির্ভর করে। বাচ্চা কচ্ছপরা একটি ভ্রণ থলে নিয়ে
জন্মগ্রহণ করে যা তাদের ৩ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত পুষ্টি সরবরাহ করে থাকে।