তৃতীয় অধ্যায়: সৃজনশীল প্রশ্ন- প্রশ্ন-১
: উদ্দীপকটি পড়ে প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও। আজমল সাহেব ১০ বছর পর কাতার থেকে
দেশে ফিরে তার ছেলে- মেয়েদের পরিবর্তন দেখে বিস্মিত হলেন। তার মেয়ে
ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঘরে বসেই নতুন নতুন তথ্য ও দেশ-বিদেশের খবর জানছে।
ছেলে ফেসবুকে বন্ধুদের সাথে যোগাযোগের পাশাপাশি অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
সংগ্রহ করছে। তার ছোট ভাই বিদেশ থেকে অনলাইনে টাকা পাঠাচ্ছে। বাড়ির অন্য
সদস্যদের জীবন যাপনেও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ক) সামাজিক উন্নয়ন কী?
খ) অন্য সংস্কৃতি ধারা নিজ সংস্কৃতিতে আয়ত্ত করাকে কী বলে? ব্যাখ্যা করো।
গ) আজমল সাহেবের পরিবারে কী ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়? বিশ্লেষণ করো।
ঘ) উদ্দীপকের বৈচিত্র্যগুলো সমাজ পরিবর্তনে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে?
তোমার উত্তরের সপক্ষে যুক্তি দাও। উত্তর: ক) সামাজিক উন্নয়ন হলো এক ধরনের
সামাজিক পরিবর্তন। খ) অন্য সংস্কৃতির ধারা নিজ সংস্কৃতিতে আয়ত্ত করাকে
সাংস্কৃতিক আত্তীকরণ বলে। আত্তীকরণ এমন একটি প্রক্রিয়া যে প্রক্রিয়ার
মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও গোষ্ঠী অন্যের সংস্কৃতি আয়ত্ত করে। যখন মানুষ
কোনো নতুন সংস্কৃতি বা সাংস্কৃতিক পরিবেশে বাস করতে আসে, তখন সেখানকার
মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, আচরণ, চিন্তাচেতনা, মূল্যবোধ এককথায় সমগ্র জীবনধারার
সাথে আত্তীকৃত হতে চেষ্টা করে। এভাবে একসময় আত্তীকরণ হয়ে যায়। যেমন বিয়ের
পর মেয়েরা শ্বশুরবাড়ির সংস্কৃতির সাথে নিজেকে আত্তীকরণে চেষ্টা করে। গ)
আজমল সাহেবের পরিবারে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। মানুষের
জীবনপ্রণালীর পরিবর্তনই সাংস্কৃতিক পরিবর্তন। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার
করায় আজমল সাহেবের পরিবারের সদস্যদের জীবনপ্রণালীর সামগ্রিক চিত্র পাল্টে
গেছে। আধুনিক প্রযুক্তি বা বস্তুগত সংস্কৃতির দ্রুত পরিবর্তন ও উন্নয়ন
সমাজে সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ঘটায়। তথ্য-প্রযুক্তির উন্নয়নে গোটা বিশ্ব এখন
বিশ্বপল্লীতে রূপান্তরিত হয়েছে, যার ফলে যোগাযোগ প্রক্রিয়া অনেক উন্নত
হয়েছে। এখন ঘরে বসে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের খবর জানা যায়। এ
ছাড়া মানুষ ঘরে বসে ফেসবুক, মিডিয়ার মাধ্যমে বিনোদনের চাহিদা পূরণ করছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন সাংস্কৃতিক পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে। যেমন:
প্রবাসীরা এখন অনলাইনে টাকা পাঠাচ্ছেন। উদ্দীপকে দেখা যায়, আজমল সাহেব ১০
বছর পর বিদেশ থেকে দেশে ফিরে দেখেন তার মেয়ে ইন্টারনেট থেকে ঘরে বসে নতুন
নতুন তথ্য ও দেশ-বিদেশের খবর নিচ্ছে। তার ভাই বিদেশ থেকে অনলাইনে টাকা
পাঠাচ্ছে। ছেলে ফেসবুক ব্যবহার করে বন্ধুদের সাথে যোগাযোগের পাশাপাশি
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করছে। পরিবারের অন্য সদস্যদের জীবনে পরিবর্তন
লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই পরিবর্তন জীবনকে সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করেছে।
সদস্যদের ইতিবাচক পরিবর্তন একটি সাংস্কৃতিক উন্নয়ন তথা সাংস্কৃতিক
পরিবর্তন। ঘ) হ্যাঁ, উদ্দীপকের বৈচিত্র্যগুলো সমাজ পরিবর্তনে ইতিবাচক
ভূমিকা পালন করছে বলে আমি মনে করি। উত্তরের সপক্ষে যুক্তি হলো- সাধারণত বা
সামাজিক উন্নয়ন হলো এক ধরনের সামাজিক পরিবর্তন। কোনো সমাজে উন্নয়নের ফলে
যেমন সাংস্কৃতিক পরিবর্তন হয়, তেমনি সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ফলেও উন্নয়ন
ঘটে। প্রযুক্তির উন্নয়ন সাংস্কৃতিক পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে।
তথ্য-প্রযুক্তির উন্নয়নে গোটা বিশ্ব এখন একটি বিশ্বপল্লীতে রূপান্তরিত
হয়েছে, যার ফলে যোগাযোগ প্রক্রিয়া অনেক উন্নত হয়েছে। যেমন- ইন্টারনেটের
মাধ্যমে ঘরে বসেই বহির্বিশ্বের বিভিন্ন তথ্য জানা যায়। ফেসবুকের মাধ্যমে
দেশ-বিদেশের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের সাথে সহজেই যোগাযোগ করা যায়। এর
ফলে আমাদের জ্ঞান ও সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের জীবনযাত্রার সার্বিক
পরিবর্তনের ফলে সমাজ উপকৃত হচ্ছে। দিন দিন সামাজিক সম্পর্ক আরও সুগঠিত
হচ্ছে, যা আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার পরিবর্তন
ঘটাচ্ছে। উদ্দীপকে আজমল সাহেবের পরিবারে তথ্য-প্রযুক্তির উল্লিখিত দিকগুলোর
ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। তথ্য-প্রযুক্তির এরূপ বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার তার
পরিবারের সদস্যদের কাজকে সহজতর করেছে। এভাবে তথ্য-প্রযুক্তির উন্নতি সমাজে
ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটায়। সুতরাং ওপরের বর্ণনার আলোকে বলা যায় যে উদ্দীপকে
বর্ণিত তথ্য-প্রযুক্তির বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার সমাজ পরিবর্তনে ইতিবাচক
ভূমিকা পালন করে। প্রশ্ন-২: তথ্যটি দেখে নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও। ‘ক’
শিল্প : উপাদান-পোড়ামাটির শিল্প, তালপাতার শিল্প, নকশিকাঁথা, কষ্টিপাথর।
‘খ’ শিল্প: উপাদান- চর্যাগীতি, কীর্তনগান, মঙ্গলকাব্য, পুঁথিসাহিত্য, গদ্য
সাহিত্য। ক) চর্যাপদের কাল নির্ণয় করেন কে? খ) সংস্কৃতি ব্যাপ্তি কী?
ব্যাখ্যা করো। গ) উদ্দীপকে বর্ণিত ‘ক’ শিল্পটির ধরন ব্যাখ্যা করো। ঘ)
‘বাঙালির সংস্কৃতির বিকাশে ‘খ’ শিল্পটির গুরুত্ব অপরিসীম’ বিশ্লেষণ করো।
উত্তর: ক) চর্যাপদের কাল নির্ণয় করেন ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। খ)
মানুষ সমাজে নিজের প্রয়োজনে নানা কিছু সৃষ্টি করে। সৃষ্টিশীল সব কাজই তার
সংস্কৃতি। সমাজ ও অঞ্চলভেদে সংস্কৃতির রূপ ভিন্ন হয়ে থাকে। সাধারণত দুটি
সমাজের সংস্কৃতি একে অপরের সংস্পর্শে এসে একে অপরকে প্রভাবিত করে। এই কাছে
আসা যত বেশি ও দীর্ঘস্থায়ী হবে, সংস্কৃতির আদান-প্রদান ততো বেশি হবে। এর
মাধ্যমে একে অপরের সংস্কৃতির কিছু না কিছু গ্রহণ করবে। সংস্কৃতির এই চলমান
গতিধারা এবং এক সমাজ থেকে আরেক সমাজে সংস্কৃতির প্রসার লাভকে সাংস্কৃতিক
ব্যাপ্তি বলে। অর্থাৎ সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক প্রসার বা
ব্যাপ্তি ঘটে। বিশ্বায়নের ফলে এবং প্রযুক্তির উন্নতিতে সাংস্কৃতিক ব্যাপ্তি
অনেক বেড়ে গেছে। গ) উদ্দীপকে বর্ণিত ‘ক’ হলো দৃশ্যশিল্প। পোড়ামাটির শিল্প,
তালপাতার শিল্প, নকশিকাঁথা ও কষ্টিপাথর। এগুলো বস্তুগত শিল্প বা সংস্কৃতি
হিসেবে পরিচিত। বস্তুগত শিল্পই দৃশ্যশিল্প। নিচে এ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করা
হলো। দৃশ্যশিল্পের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পোড়ামাটির শিল্প। মাটির
ফলক বা পাত তৈরি করে তাতে ছবি উৎকীর্ণ করে পুড়িয়ে স্থায়ীরূপ দেওয়া।
এগুলোকে টেরাকোটা বা পোড়ামাটির শিল্প বলা হয়। এ ছাড়া কালো রঙের কষ্টিপাথর
আর নানা রকম মাটি দিয়ে হিন্দু ও বৌদ্ধ দেবদেবীর মূর্তি বানানোর ঐতিহ্যও বেশ
পুরনো। তবে পাল যুগে তালপাতার পুঁথিতে দেশীয় রঙ দিয়ে যেসব ছবি আঁকা হয়েছে
তার প্রশংসা আধুনিক বিশ্বের শিল্পরসিকদের কাছ থেকেও পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে
বাংলার নকশিকাঁথার ঐতিহ্য অনেক পুরনো। গ্রামীণ মহিলারা ঘরে ঘরে কাঁথা
সেলাই করে আশ্চর্য নিপুণতায় গল্পকাহিনি ও ছবি ফুটিয়ে তোলেন। এখনো সমাজে
দরিদ্র নারীরা এই শিল্প কর্মটি টিকিয়ে রেখেছেন। উদ্দীপকে ‘ক’ শিল্পের
উপাদানগুলো দৃশ্যশিল্পের অন্তর্ভুক্ত বিধায় ধরন অনুযায়ী ‘ক’ শিল্পটি
দৃশ্যশিল্প। ঘ) উদ্দীপকে ‘খ’ শিল্প হলো সাহিত্যিক উপাদান অর্থাৎ সংস্কৃতির
অবস্তুগত উপাদান। বাংলা সংস্কৃতির বিকাশে এই সাহিত্যিক উপাদানগুলোর গুরুত্ব
অনেক। নিচে তা বিশ্লেষণ করা হলোÑ বাঙালির প্রথম যে সাহিত্যকর্মের সন্ধান
পাওয়া যায়, তা চর্যাপদ নামে পরিচিত। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে থেকে বৌদ্ধ
সাধকরা লিখেছেন, এগুলো হলো আদি বাংলা সাহিত্যের নমুনা। চর্যাগীতির বিখ্যাত
রচয়িতাদের মধ্যে ছিলেন লুইপা ও কাহ্নপা প্রমুখ। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
প্রথম নেপালের রাজ দরবার থেকে এগুলো আবিষ্কার করেন। অন্যদিকে সুলতানি আমলে
শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণব ভাবধারার প্রভাবে বাংলায় কীর্তন গান রচনা শুরু হয়, যা
বৈষ্ণব পদাবলি নামে পরিচিত। অনেক মুসলমান কবিও এই পদাবলি রচনা করেন, যাতে
সেই সময়ের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নমুনা ফুটে ওঠে। শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার
কাহিনি নিয়ে কীর্তনগান রচিত হয়েছে। একসময় বাংলায় দেশীয় দেবদেবীকে নিয়েও
নানা কাহিনি রচিত হয়েছে। এগুলো মঙ্গলকাব্য নামে পরিচিত। ভারতচন্দ্রের
অন্নদামঙ্গলে সেকালের বাংলা সমাজচিত্র পাওয়া যায়। মুসলমান সমাজে একসময়
পুঁথিসাহিত্যের ব্যাপক কদর ছিল। পারস্য থেকে পাওয়া নানা কল্পকাহিনি ও
রোমান্টিক আখ্যান নিয়ে এগুলো রচিত হতো। পরবর্তীকালে উনিশ শতকে আমাদের দেশে
বাংলা গদ্যের সূচনা হয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ভিত
রচনা করেন। বঙ্কিমচন্দ্র ও সমসাময়িক সাহিত্যিকরা যার ওপর সৌধ তুলেছেন আর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে শোভন ও সুন্দর করে পূর্ণতা দিয়েছেন। কাজী নজরুল
ইসলাম, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, মীর মশাররফ হোসেন, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখ
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বিকাশে ভূমিকা রেখেছেন। সার্বিক আলোচনার
পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে সাহিত্যশিল্প বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ
এবং ধীরে ধীরে তা বিকশিত হয়েছে। তাই ‘খ’ শিল্পের উপাদান হিসেবে চর্যাপদ,
কীর্তনগান, মঙ্গলকাব্য, পুঁথিসাহিত্য ও গদ্যসাহিত্য বাঙালি সংস্কৃতি বিকাশে
গুরুত্ব অপরিসীম।
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)